মা তোমার কি মনে আছে, একটা লোক তোমার কোল থেকে ৮ মাস বয়সী একটা ফুটফুটে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল অনেকদূরে ? সেই লোকটা তারপর সেই ৮ মাসের ছেলেটিকে আর তোমার বড় সতিনের মেয়ে পেয়ারীকে সাথী করে চলে গিয়েছিল ট্রেন স্টেশনে। সেখানে, সেই ট্রেনে কোন সিট ছিল না। তাছাড়া ট্রেন প্রায় ছেড়েও দিয়েছিল। লোকটি তার বড় মেয়েকে জানালা দিয়ে ছুড়ে দিয়েছিল, আর সেই ৮ মাসের ছেলেটিকে লোকটি তার কোলে পিঠে করে আগলে রেখে লাফিয়ে উঠেছিল ট্রেনের জানালা গলে। মা, সত্যি বলছি, লোকটি ৮ মাসের ঐ ছেলেটিকে অনেক ভালোবাসার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু পারেনি। বলো মা, মায়ের মতো করে কি কেউ ভালো বাসতে পারে? পারে না। কারণ, মা; মা-ই। তুমি কি মা উপন্যাসটা পড়েছিলে, কোন অবসর আলোতে ভিজে ভিজে? ম্যাক্সি গোর্কি যেভাবে মায়ের প্রতি ভালোবাসা, রাগ অভিমান আর সম্মান দেখিয়েছে; ঠিক সেভাবে ছেলেটি পারেনি। যাই হোক মা, স্নেহের পালকিতে চড়া হয়নি সেই ছোট্ট ছেলেটির। দেখেনি সে মায়ের আদরের নদী, পাল তোলা নাও আর উথাল করা ঢেউ। কেউ তাকে বলেওনি যে, মা সন্তানকে কতটা ভালোবাসে। তারপরও ছেলেটি বুঝেছে, দীর্ঘ ২৭ বছর পার হয়ে এসে বুঝেছে মা কেমন হয়। কিভাবে আঁকড়ে রাখতে চায় তার সন্তানকে। ছেলেটির পারপাশে মা দিবসের মুখরতা আজ। এগুলো হয়তো কর্পোরেট বাতাসে ভেসে আসা ট্রেন্ড নয়। সবাই আসলেই মা\'কে ডেডিকেট করছে আজকে। দেখতে ছেলেটির কাছে এসবভালো লাগে, তবে নিজেকে মনে হয় আবারো অসামাজিক! আমি মা\'কে কিছুই ডেডিকেট করিনাই আজকে। বলিও নাই একবার, শুভ মা দিবস, মা! আমার মা\'ও বেরসিক, সে ২৭ বছর যা করেছে, আজও তাই করছে। ছেলেটি ঘুরে বেড়ালো, একা একা পুরনো শহরটায়। থমথমে, বাতাসহীন শহর। হঠাৎ ছেলেটির এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। বন্ধুটি বললো মায়ের সাথে মা দিবসের কথা। কথাগুলো এমন করেই এগিয়ে গেলো ঢেউ খেলে খেলে, 'জমজমাট পার্কটা যেন কবর হয়ে গেছে কোন কারণে - বিরক্ত আমি আসলাম বাসায়, এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। উইশ হয়তো করা যায়, গিফট আনিনি কোন, তাতে কি! তাও করবো না। রোজকার মত জ্বালানো শুরু করলাম মা\'কে। আমার মা এতেই আনন্দ পায়!!'
২.
মা দিবসে সবাই নতুন স্টাইলে গদ্য, পদ্য লিখে যায় তার মাকে নিয়ে , কার মা কতো ভালো তাই দেখাতে একেক জনের চেয়ে আরেক জন পিছিয়ে নেই। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের কাছেই তার মা হচ্ছে জান্নাত। সন্তানের জন্য তার ত্যাগ, মায়া মমতা যে কতো তা বলে শেষ করা যায় না। তবে আমরাই কি সেই লোক নই , যারা কোন কিছুতেই আরেকজনের মা কে প্রথমে গালি দেই। মা...র পুত...। যেই লোকটার মাকে গালি দিচ্ছি, সেতো কোন দোষ করেনি, অথচ সেই ছেলের জন্য আমরা তার মাকেই আগে গালি দেই। যাকে গালিটা দিলাম , সেওতো আমার মায়ের মতই , আমার মাকে ভালোবাসতে পারলে আরেক জনের মাকে গালি দেবো কেন? আমার কাছে আমার মা যেই রকম, সবার কাছেই তাদের মা ও ঐ রকম। সবই অনর্থক মনে হয়।
৩.
তোমাকে কেন যেন আজ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আর তাই ফিরে আসিনি তোমার দুঃখের আঁচল সন্ধ্যায়। মা দিবসের ভাবনাটা আমার এমনই। আজকে মা দিবস। সময়ের নানা অংশ জীবনে একটা প্রভাব রাখে জানি। এজন্যই বুঝি মানুষের জীবনে একেকটা সময়ের আবেদন একেক রকম। সেই আবেদনগুলো ধরাও দেয় ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গে। সময় নিয়ে বলতে গেলে অনেক কিছুই বলা যায়। পদার্থবিজ্ঞানীরা আবার একে চলমান সময় বলতেই পছন্দ করেন। আইনস্টাইন যেমনটা শুরু করেছিলেন- আপেক্ষিক সময়। সময় নিয়ে কিছু ভাবতে গেলে বড়জোর আমি আন্তর্জালে একটা জানালা খুলে উকি দেই খোঁজাখুঁজির জগতে। সার্চ দেই টাইম লিখে। ফলাফলগুলো খুব বেশি তাড়িত করে না আমাকে। কিছুতে সন্তুষ্ট না হয়ে নিজের নাম দিয়েই সার্চ দেই। যাকে বলা হয় ইগো সার্চিং। এইসব হাবিজাবি কাজগুলো খুব বেশি তাড়িত করে না আমাকে। শুধু কোন কোন অনুষঙ্গে কিছু বিষয়ের ভাবনা থেকে রেহাই দেয়। তারচেয়ে ঢের শৈশবের সময়গুলো কিংবা স্কুলে কাটিয়ে আসা সেই সময়টাই আমাকে বেশি তাড়িত করে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে নিজের বাড়িতে, নিজের গ্রামে, নিজের চিরচেনা পরিমণ্ডলে, নিজের পথ ঘাটে হেটে চলা, বাস করার সমময়গুলোই আমাকে বেশি তাড়িত করে, বেশি করে ভাবায়। মানুষ মাত্রই তার স্মৃতি তাড়না থাকবে। নস্টালজিয়া শব্দটাকেই আমরা প্রায়শই এক্ষেত্রে যুতসই শব্দ হিসাবে ব্যবহার করি। যদিও নস্টালজিয়া মানে আক্ষরিক অর্থে হোমসিকনেস জাতীয় কিছু। যা বলতে ছিলাম, মানুষ মাত্রই নস্টালজিয়া থাকে, শৈশব নিয়ে ভাবনা থাকে। অনেকেরই সেই সময়টাতে ফিরে যাওয়ার একটা আকুতি থাকে। আমার এ ধরনের আকুতি আছে কিনা ঠিক বুঝতে পারি না। হয়তো ঠিক করে বোঝার চেষ্টা করি না। হয়তো চাই আবার চাই না! শৈশবের সময়টাতে সকালের ঘুম ভাঙ্গত পাখির ডাকে। অন্যদের বেলা মায়ের ডাকে। অথচ আমার কোন মা ছিল না। মা বিহীন সন্তান আমি। বাবা বিহীন হযরত ঈসা (আ.) বা যীশুর মতো আমার বাবা না থাকলেও কোন দুঃখ ছিল না। কিন্তু আমার মা-ই নেই, এই দুঃখ রাখার কোন জায়গা আমার নেই। অলস এই আমি যদিও চাইতাম দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো তারপরেও তা হতো না। এখন আমি ইচ্ছামতো ঘুম থেকে উঠি। অনেক বেলা করে প্রায়শই ঘুম থেকে উঠি। তারপরেও শৈশবের সেই ঘুম থেকে উঠাকে খুব বেশি মিস করি। মা হীন, স্বজনহীন সকাল আমার। কেটেছে আঁধারে, আলোতে। জীবনের অনেকটা সময় পর্যন্ত প্রায় সব কাজের জন্যই নিজের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। আমার অবশ্য একটা রোদ ছিল, সেই রোদ ঠিক ঠিকই কাজগুলো করে দিতো। হয়তো স্কুলে যাবো...বই গোছানো, কাপড় রেডি করা সবই করে দিতো আমার রোদ। খুব শৈশবে প্রায়শই রোদ ছোট্ট ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করতো, এই যে তোকে সব কাজ করে দিতে হয়, তুই বড় হয়ে চলবি কি করে? সেই ছোট ছেলেটা হেসে জবাব দিত, রোদাম্মু সবসময়তো আমি তোমার সাথেই থাকব। তাহলে চিন্তা কিসের? রোদাম্মু থেমে গিয়ে বলতো...তাইতো তুই সবসময় আমার সা্থেই থাকবি...কিন্তু তারপরেও জীবনে কাজের জন্য তোকে অনেক কিছুই করতে হবে, বাড়ি থেকে দুরে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। ছোট্ট সেই ছেলেটি তখন কিছু না বলে ভাবতো হায় এতো কঠিন কেন বিষয়গুলো! রোদটাই আমার মা। এই মায়ের আদরে মেতে উঠি আমি।
৪.
এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত যেই ছেলেটি কোনদিন রোদমাকে ছাড়া কোথাও বেড়াতে যায়নি। সেই ছেলেটি পরীক্ষার পরে হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেল যেন। মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে বাড়ি থেকে দুরে গিয়ে থাকা শুরু হয়। মনে পড়ে তখন স্কুলে পড়তাম। বন্ধুদের হঠাৎ সিদ্ধান্তে ফুটবল খেলার জন্য গিয়েছিলাম পাশের গ্রামে। রোদাম্মুকে বলে যেতে পারিনি। পরে খেলার কারণে বেশ রাত হয়ে যায়। বাড়িতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ওদিকে বাড়িতে আম্মু চিন্তায় অস্থির। সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। অবশেষে বাড়ি ফিরলাম যখন কি যে অবস্থা! অথচ এখন আমি প্রতি রাতেই বেশ রাত করে বাসায় ফিরি। কখনো মধ্যরাতেও বাসায় ফিরি। এভাবেই চলছিল...
৫.
রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা ঘুমঅলা মানুষগুলো মাঝেমধ্যে মাথা উঠিয়ে তাকায়। খুব অলস ঘুমঅলা মানুষেরা জিজ্ঞেস করে বসে, কে যায়? আমি উত্তর দেই না। সব কথার উত্তর কেন জানি দিতে ইচ্ছে হয় না। বাসায় এই যে দেরি করে ফিরি, কেউতো আমার খোঁজ করে না আম্মু। কতো রাতে ফিরলাম বিবেচ্য বিষয় না মোটেও এখন। রাতে ফিরে একা একা সব কিছু করে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। সময় কি খুব বেশি বয়ে গেল তবে? স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে ৪টা কিংবা সাড়ে ৪টা বেজে যেত। আমি প্রতিদিনই দেখতাম রোদাম্মু তুমি অপেক্ষা করে আছো। মা দিবস বলে একটা দিন আছে সেই দিনটা নিয়ে খুব বেশি সচেতন নও তুমি। কবে দিনটি আসলো, কবে চলে গেল তা তুমি মোটেও খেয়াল করো না। আমিও তোমাকে কখনো আলাদা করে মনে করিয়ে দেই না, আজ মা দিবস। আমার কাছে প্রতিদিনই মায়ের জন্য দিবস, প্রতিদিনই তোমাকে ভাবার দিবস রোদাম্মু। আর এই বোধটা আছে বলেই পৃথিবীর সব মায়েরা আমার অজান্তে হয়ে উঠেছে রোদাম্মু...